শিব চতুর্দশী ব্রতের শুদ্ধ তিথি কবে?
(যারা শাস্ত্রীয় রেফারেন্স চাইছিলেন, তাদের উদ্দেশ্যে)
---বেশি করে শেয়ার করে জানিয়ে দিন সকলকে--
============= উত্তর ==============
স্কন্দপুরাণে শিবরাত্রিব্রতনির্ণয় বিষয়ে পরাশর মুনি স্পষ্টভাবে বলেছেন, অমাবস্যা সংযুক্ত চতুর্দশী তিথিতে শিবরাত্রি ব্রতই শিবের প্রিয়, কোন অবস্থাতেই ত্রয়োদশীযুক্ত চতুর্দশীতে
মাঘাসিতং ভূতদিনং হি রাজমুপৈতি যোগং যদি পঞ্চদশ্য ।।
জয়াপ্রযুক্তাং নতু জাতু কুৰ্য্যাচ্ছিবস্য রাত্রিৎ প্রিয়কচ্ছিগ্যেতি।।
🔺[ স্কন্দপুরাণ, হ.ভ.বি ১৪।১৩।৭০, পরাশর উক্তি ]🔺
বঙ্গানুবাদ:
পরাশর মুনি বললেন, " হে নৃপ ! মাঘ মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশীতে অমাবস্যাযোগ হইলে সেদিন শিবরাত্রিব্রত করিবে; উহা মহাদেবের পরমপ্রীতিকর। কিন্তু ত্রয়োদশীযুক্তা চতুর্দশী তিথি সর্বাবস্থায় ত্যাজ্যা।"
১৮ তারিখ সারাদিনই ত্রয়োদশী, রাত্রিতে ১ম প্রহরের একেবারে শেষ সময়ে চতুর্দশী তিথি লাগবে। অতএব, ১৮ তারিখের চতুর্দশী তিথি ত্রয়োদশী দ্বারা বিদ্ধা(দূষিত)। বিদ্ধা তিথিতে তাই শুদ্ধভক্তগণের চতুর্দশী ব্রত করা নিষেধ।
পূর্ব্বিদ্ধা ন কর্ত্তব্যা তৃতীয়া ষষ্ঠিরেব চ।
অষ্টম্যেকাদশী ভূতা ধর্ম্মকামার্তগবাঞ্চিভি:।।
🔺[পদ্মপুরাণ সর্গখন্ড, ৪২।১২২]🔺
"ধর্মকামার্থ অভিলাষী ব্যক্তিগণ তৃতীয়া, ষষ্ঠী, অষ্টমী, একাদশী ও #চতুর্দশী কখনো পূর্ববিদ্ধা করিবে না।"
এ একই শ্লোক পদ্মপুরাণের ব্রহ্মখন্ডের ১৩।৫৯ নং শ্লোকেও উদ্ধৃত হয়েছে।
শ্রীহরিভক্তিবিলাসেও বলা হয়েছে-
শিবরাত্রিরতে ভূতং কামবিদ্ধং বিবৰ্জ্জয়েৎ ॥
🔺[শ্রীহরিভক্তিবিলাস ১৪।২০]🔺
অনুবাদ –
শিবরাত্রি ব্রতে ত্রয়োদশীবিদ্ধা চতুৰ্দ্দশী তিথি পরিত্যাগ করিতে হইবে ৷৷
১৯ তারিখে সূর্যোদয় কাল হতেই চতুর্দশী তিথি থাকায় এ তিথিটি সূর্য স্পর্শ দ্বারা পবিত্র এবং এ চতুর্দশী তিথি অমাবস্যা সংযুক্ত হওয়ায় এটি ভগবান শিবের অধিক প্রিয়।
অতএব, শুদ্ধ ভক্তগণ ১৯ তারিখেই শিবরাত্রিব্রত পালন করবেন, সেদিনই চার প্রহরব্যাপী শিবকে দুধ,দই,মধু ও ঘৃত দ্বারা অভিষেক করাবেন।
=============
✴️তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায়, অগ্নি-শিবাদি পুরাণে কেন পূর্ব দিবসে প্রদোষযুক্তা ব্রত করতে বলছে?
============
এর উত্তরে শ্রীহরিভক্তিবিলাস স্মৃতিতে বলেছে, 'প্রদোষব্যাপিনীসাম্যেঽপ্যুপোষ্যং প্রথমং দিনম্ ।
নোপোষ্যা বৈষ্ণবৈবিদ্ধা সাপীতিচ সতাং মতম্ ৷৷
🔺[হরিভক্তিবিলাস ১৪।২০৪ ]🔺
অর্থাৎ,
ভগবান বিষ্ণুর উপাসক নন যারা, তারাই পূর্বদিবসে উপবাস করে। ঐ প্রথম দিন ত্রয়োদশী বিদ্ধা হইলে প্রথম দিন ব্রতোপবাস করা বৈষ্ণবগণের কৰ্ত্তব্য নহে। ইহা সাধুগণ সম্মত ॥
✴️তাহলে শাস্ত্র কেন এখানে আবার বৈষ্ণব-অবৈষ্ণব বিভেদ করেছে?
এর উত্তর কিন্তু ভগবান শিব নিজেই সাত্ত্বিকী পুরাণে দিয়েছেন। সাত্ত্বিকী পদ্মপুরাণের উত্তরখন্ডে দেখা যায়,
অসুরেরা বিষ্ণুভক্তির ছল করে তপস্যা দ্বারা শক্তি লাভ করে সে শক্তি দিয়ে দেবলোকাদি দখল করার উপক্রম হলে দেবতারা শ্রীহরির নিকট সাহায্য প্রার্থনা করেন। সে সময় শ্রীহরি শিবকে বললেন, তিনি যেন জগতে শিবপুরাণ, লিঙ্গপুরাণাদি তামসিক পুরাণ, তামসিক স্মৃতি ও পাশুপত শাস্ত্র প্রচার করেন। শিবের এ প্রচারণায় তখন যারা প্রকৃতই অসুর, বিষ্ণুভক্তির ছল করছে, তারা বিষ্ণুবিমুখ হয়ে যাবে এবং তাদের পতন ঘটানো দেবতাদের পক্ষে সহজ হবে। কিন্তু যারা শুদ্ধভক্ত তারা জল মিশ্রিত দুধ হতে রাজহংসের ন্যায় তামসিক পুরাণ হতেও সাত্ত্বিক পুরাণের অনুকূল সাত্ত্বিকী বিধিগুলো সাররূপে গ্রহণ করবে, সাত্ত্বিকপুরাণ বিরোধী তামসিক নির্দেশ বর্জন করবে এবং বিষ্ণুভক্তিতে একনিষ্ঠ থাকবে।
পুরাণানি চ শাস্ত্ৰাণি ত্বয়া সত্ত্বেন বৃংহিতাঃ। কপালচৰ্ম্মভস্মাস্থিচিহ্নাসমরসৰ্ব্বশঃ। ৩০
ত্বমেব ধৃতবান্ লোকান্ মোহয়ম্ব জগত্ৰয়ে ।
তথা পাশুপতং শাস্ত্ৰং ত্বমেব কুরু সৎস্কৃতঃ ॥৩১
কঙ্কালশৈবপাষণ্ডমহাশৈবাদিভেদতঃ।
অলক্ষ্যঞ্চ মত সম্যগ্বেদবাহ্যং নরাধমাঃ ॥ ৩২
ভস্মাস্থিধারিণঃ সর্ব্বে ভবিষ্যন্তি হচেতসঃ।
ত্বাং পরত্বেন বক্ষ্যন্তি সৰ্ব্বশাস্ত্রেষু তামসাঃ ॥৩৩
তেষাং মতমধিষ্ঠায় সর্ব্বে দৈত্যাঃ সনাতনাঃ।
ভবেয়ুস্তে মদ্বিমুখাঃ ক্ষণাদেব ন সংশয়ঃ ॥৩৪
অহপ্যবতারেষু ত্বাঞ্চ রুদ্র মহাবল।
তামসানাং মোহনার্থং পূজয়ামি যুগেযুগে।
মতমেতদবষ্টভ্য পতস্ত্যেব ন সংশয়ঃ ॥৩৫
🔺[ পদ্মপুরাণ, উত্তরখন্ড, অধ্যায় ২৩৫, শ্লোক ৩০-৩৫, শ্রীহরি উবাচ ]🔺
বঙ্গানুবাদঃ
শ্রীহরি শিবকে বললেন- "হে শিব! তুমি সংকোচ পরিত্যাগ করে জগতে #তামসিক_পুরাণ ও অন্যান্য তামসশাস্ত্রের প্রচার করো। তুমি কপাল, চর্ম্ম, ভস্ম ও অস্থি চিহ্ন ধারণ করে ত্রিজগতের অখিল লোককে মোহিত কর। তুমি পাশুপাত্ শাস্ত্ৰ প্রণয়ন করে তা প্রচার কর। তুমি কঙ্কাল, শৈব, পাষণ্ড ও মহাশৈব প্রভৃতি বিভিন্ন সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠিত করে বেদবিরুদ্ধ মত অলক্ষ্যে প্রবর্তিত কর। এইরূপ করলে সকলে ভস্মাস্থিধারণ করে অধম হবে ও জ্ঞানহীন হয়ে যাবে। তখন তারা তামসিক হয়ে তোমাকেই সকল শাস্ত্রে শ্রেষ্ঠ বলে কীৰ্ত্তন করবে। (যারা ভক্তির ছল করে শক্তিপ্রাপ্ত হয়ে ত্রিলোকে উৎপাত সৃষ্টি করে) সে সকল সনাতন দানবগণ এ বেদবিরুদ্ধ মত গ্রহণ করে ক্ষণকাল মধ্যে নিঃসংশয় বিষ্ণুবিমুখ হয়ে যাবে। হে মহাবল রুদ্র ! আমিও যুগে যুগে অবতার পরিগ্রহ করে তামসিক লোকদের মোহিত করার জন্য তোমার পূজা করব। তা দেখে দানবেরাও সেই মতের অনুবর্তী হইয়া নিঃসংশয় পতিত হইবে।"
[ এখানে উল্লেখ্য, ভগবান শিব যে বেদবিরুদ্ধ 'পাশুপতমত' প্রচার করেছেন, তিনিই আবার শ্রী শঙ্করাচার্য্যরূপে আবির্ভূত হয়ে নিজের ব্রহ্মসূত্রভাষ্যে পাশুপত মতকে খন্ডন করেছেন ]
এটুকু বর্ণনার পর ভক্তপ্রবর শিবজি মহারাজ তার দ্বারা প্রচারিত তামসিক পুরাণসমূহের নাম বর্ণনা করেছেন এবং স্পষ্টভাবে ঘোষণ করেছেন- ' তামসিক পুরাণ অনুসারীগণ নিশ্চিতভাবে নরকপ্রাপ্ত হন।'
মাৎস্যং কৌৰ্ম্মং তথা লৈঙ্গং শৈবং স্কান্দং তথৈব চ।
অগ্নেয়ঞ্চ ষড়েতানি তামসানি নিবোধ মে॥ ১৮
সাত্ত্বিকা মোক্ষদাঃ প্রোক্তা রাজসাঃ সর্ব্বদা শুভাঃ।
তথৈব তামসা দেবি নিরয়প্রাপ্তিহেতবঃ ॥
🔺[ পদ্মপুরাণ, উত্তরখন্ড, অধ্যায় ২৩৬, শ্লোক- ১৮,১৯,২১, ২২, শিব উক্তি ]🔺
বঙ্গানুবাদঃ
শিব বললেন, "মৎস্যপুরাণ, কুৰ্ম্মপুরাণ, লিঙ্গপুরাণ, শিবপুরাণ, স্কন্দপুরাণ ও অগ্নিপুরাণ - এই ছয়খানি পুরাণ তামসিক পুরাণ।"
শিব পার্বতীকে আরো বললেন, "হে দেবি ! পদ্মপুরাণাদি সাত্ত্বিক পুরাণসমূহ মোক্ষ প্রদান করে। ব্রহ্মান্ডপুরাণাদি রাজসিক পুরাণ সর্ব্বদা শুভ এবং #শিব-অগ্নি-লিঙ্গাদি তামসিক পুরাণগুলো নিশ্চিতভাবে #নরক প্রাপ্তির কারণ বলে নির্দিষ্ট। "
অতএব, পদ্মপুরাণাদি সাত্ত্বিক পুরাণের সাথে অগ্নি-শিবাদি তামসিক পুরাণের যে বিরোধ দৃষ্টিগোচর হয়, তা ভগবান বিষ্ণু ও শিবেরই পরিকল্পনা অনুসারে জগতকে অসুরদের হাত থেকে রক্ষার জন্য করা হয়েছে। অসুরেরা তামসিক শাস্ত্র অনুসরণ করে রাবণ,কংস,জরাসন্ধাদি উগ্র শিবভক্তের মত শুদ্ধ ভক্তিচ্যুত হয়ে যাবে। উগ্র শিবভক্তির দরুন আশুতোষ ভগবান রাবণাদি অসুরদের স্বর্ণলঙ্কা কিংবা দশ হাজার পাটরাণী ইত্যাদি প্রদান করেন বটে, কিন্তু তা অনিত্য। অন্তিমে শিবজী স্বয়ং-ই এ সমস্ত সম্পত্তির নাশ করেন। যেমন: ভগবান শিব রাবণকে যে স্বর্ণলঙ্কাদি বৈভব প্রদান করেছিলেন এবং লঙ্কার নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছিলেন, তিনিই আবার হনুমানরূপে অবতার নিয়ে রাবণের স্বর্ণলঙ্কা পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছিলেন, রাবণকে নির্বংশ করে দিয়েছিলেন।
শাস্ত্র হতে আরো দেখা যায়, দ্রৌপদী পূর্বজন্মে শিবের উগ্র তপস্যা করে পতি লাভ করতে চাইলে আশুতোষ শঙ্কর তাকে একেবারে পাঁচজন পতি পাওয়ার বর দিয়ে বিড়ম্বনায় ফেলেন। আবার সে শিবই দ্রোণাচার্যের পুত্র অশ্বত্থামারূপে অবতার নিয়ে দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্রকে নাশ করেন।
পরম বৈরাগি শিবের নিকট তাই শুদ্ধভক্তি বিনা অন্য কোন কিছু চাইতে নেই। ভগবান শিবের বেশভূষা লক্ষ্য করলেই দেখা যায়, তিনি স্বর্ণালঙ্কার পরিধান করেন না, ছাল চামড়া পড়ে থাকেন গলায় শাপ মুড়িয়ে। তিনি কোনরূপ বিলাসীতা করেন না। কেবল পঞ্চমুখে পদ্মবীজের মালায় রাম নাম জপ করেন। তাকে অনুসরণ করে আমাদেরও কৃষ্ণভক্তিই চাওয়া উচিত তাঁর নিকট, অনিত্য জড় সুখ কামনা করলে তিনি তা প্রদান ঠিকই করেন, কিন্তু তা ধংসও করে দেন। কারণ, তিনি মহারুদ্র, প্রলয়ের দেবতা, ধংসকর্তা বীরভদ্র।
👉👉👉 পরীক্ষায় ৩৩ পেয়েও পাশ করা যায়, ৮০ পেয়েও পাশ করা যায়। কিন্তু যারা ৩৩ পেয়েই সন্তুষ্ট, ৮০ পাওয়ার মাহাত্ম্য বুঝে না বা বুঝতে চায় না তাদের মূঢ় ব্যতীত আর কিই বা বলা যায়। একইভাবে সমাজে কিছু মানুষ আছে, যাদের যতই শাস্ত্রপ্রমাণ দেখান না কেন, তারা কিছুতেই শাস্ত্র নির্দেশিত উত্তম তিথিতে ব্রত না করে, অধম তিথিতে ব্রত করবে। ফলে তারা কেবল ক্ষণস্থায়ী সুখ পায়, যা অল্পকাল পড়েই ধংস হয়ে যায়। কিন্তু যারা বিচক্ষণ, তারা শাস্ত্রসিদ্ধান্ত দেখার সাথে সাথে তা গ্রহণ করে, তারা অচিরে কৃষ্ণভক্তি লাভ করে। কৃষ্ণ হলেন লক্ষ্মীপতি। গীতায় ভগবান বর্ণনা করেছেন, যেখানে শ্রীকৃষ্ণ থাকেন, সেখানে শ্রী অর্থাৎ লক্ষ্মীদেবী সর্বদা থাকেন। অর্থাৎ, কৃষ্ণভক্তগণ জ্ঞানী হওয়ায় ক্ষণস্থায়ী বৈভব না চেয়ে কৃষ্ণকেই প্রার্থনা করেন ভগবান শিবের নিকট, কৃষ্ণকে প্রাপ্ত হলে সমস্ত ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ ভক্তের কুক্ষীগত হয়।
শ্রীকৃষ্ণে বৈষ্ণবানান্ত প্রেমভক্তিবিবন্ধ
কৃষ্ণভক্তিরসাসার বধিরুদ্রানুকম্পা ।।
🔺[শ্রীহরিভক্তিবিলাস, ১৪।২২১]🔺
অনুবাদ –
বৈষ্ণবগণের পক্ষে শিবরাত্রি ব্রতপালনে কৃষ্ণভক্তিরস সারবর্ষণকারী শ্রীরুপ্রদেবের অনুগ্রহে শ্রীকৃষ্ণে প্রেমভক্তি বিশেষভাবে বদ্ধিত হয়।
।। হরে কৃষ্ণ।।
Comments
Post a Comment